হিংসার আগুনে জ্বলছে মণিপুর। প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাড়িছাড়া হয়েছেন ৩৫,০০০-এরও বেশি মানুষ। রাজ্যটিতে এই গোষ্ঠী সংঘর্ষের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য তিন সদস্যের প্যানেল তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই পদক্ষেপটিকে স্বাগত জানাতেই হয়। এই প্যানেলের মূল কাজ হবে হিংসার কারণ এবং কর্তব্য পালনে কর্তৃপক্ষের কোনো ত্রুটি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজ্যে হিংসার প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব হতে পারে। এর পাশাপাশি গোষ্ঠী সংঘর্ষের ক্ষতে প্রলেপও লাগাতে পারে এই উদ্যোগ। কোনো চালিকা শক্তি ছাড়া দাঙ্গা এবং গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনা বিরল। পুলিশের থেকে লুট করে নেওয়া অস্ত্র মণিপুরের এই হিংসায় যে ব্যবহার করা হয়েছে, এই প্রসঙ্গে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এই হিংসার ঘটনার দায় কাদের তা নির্ধারণ করলে, রাজ্যে যাদের ওপর প্রশাসন চালানোর গুরুদায়িত্ব রয়েছে, তাদের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হবে। মণিপুরে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পরেও রাজ্যে হিংসার আগুন থামেনি। লুট করা অস্ত্রের মধ্যে কেবলমাত্র ১৮% ফেরত দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে মেইতি এবং কুকি, এই দুই কমিউনিটির মধ্যে অবিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে। এর পাশাপাশি এটাও স্পষ্ট হয়েছে, রাজ্যে দীর্ঘমেয়াদীভাবে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য সরকার।
হিংসা প্রতিরোধ করার জন্য মণিপুরে আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানরা টহল দিচ্ছেন। কুকি সম্প্রদায়ের লোকজন যেখানে বসবাস করেন, সেই ইম্ফল ভ্যালি এবং সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকার মধ্যে থাকা বাফার এরিয়াকে তারা সুরক্ষা জোগাচ্ছেন। তবে এই সাহায্য বা পদক্ষেপটি পর্যাপ্ত নয়। দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা বিধায়কদেরকে, বিশেষ করে যারা নিজেদের জাতিগত পরিচয়ের জন্য পরিচিত, তাদেরকে রাজ্যে শান্তি প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সেগুলোর সমাধান করার ব্যাপারে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা এবং অনুধ্যায় প্রয়োজন। এই কাজগুলো মোটেও সহজ হবে না। কুকি (এবং নাগা) সম্প্রদায়ের অনেকেই দাবি করেন যে, মেইতিদের জন্য তপশিলি উপজাতি স্ট্যাটাসের যে দাবির বিরুদ্ধে তাদের জনগেষ্ঠীর একাংশ সরব হয়েছেন, তা অন্যায্য ব্যাপার। অন্যদিকে মেইতিরা পাহাড়ি উপজাতির জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের সুবিধার দিকটি নিয়ে সরব হয়েছে। এছাড়া মেইতিদের অভিযোগ, পাহাড়ি অঞ্চলে জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। যদিও ইম্ফল ভ্যালিতে এমনটা দেখা যায় না। জমির মালিকানা সংক্রান্ত ঐতিহাসিক প্যাটার্ন এবং কুকিদের বসবাসের ফলে তারা নিজেদের দাবির ব্যাপারে সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। তারা যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দিকেও দখলদারির হাত বাড়িয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নিয়েও তাদের মধ্যে এক প্রকারের নিরাপত্তাহীনতার মতো মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এই জটিল বিষয়গুলোর সমাধান না করলে শান্তি প্রক্রিয়া সফল হবে না। তাই এটিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হলে, এই কমিউনিটিগুলোকে অবশ্যই সংকীর্ণ গোষ্ঠী স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে, সাংবিধানিক উপায়ে সমাধান খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। হিংসার আগুনে জল ঢালার জন্য শুরুটা করা প্রয়োজন। যারা ঘর ছাড়া হয়েছেন, তাদেরকে নিজেদের ঘরে ফেরাতে হবে, সাধারণ মানুষের জীবনে সুরক্ষার আশ্বাসও দরকার। যারা হিংসা ছড়াচ্ছে, তাদেরকে ন্যায়বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাই এই সমস্ত ব্যাপারে কমিশনের কাজের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
COMMents
SHARE